প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরাতন সব স্থাপনা ভেঙ্গে অত্যাধুনিক ও বিশ্বমানের মেডিকেল কলেজ হিসেবে এটিকে প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য দরকার অনুযায়ী উন্নত টেকনোলজি ব্যবহার করে সামলে রাখা যাবে। কিন্তু আমরা এর বাইরে পুরনো বিল্ডিংগুলি ভেঙ্গে সম্পূর্ণ নতুনভাবে যুগোপযোগী প্রযুক্তি সম্পন্ন অত্যাধুনিক হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা মেডিকেলের পুরাতন ভবনগুলো ভেঙ্গে নতুন আদলে অত্যাধুনিকভাবে তৈরী করা হবে।
তিনি বলেন, পুরাতন ভবন রেখে হেরিটেজ রক্ষা করতে গেলে কোনদিন এগুলো ভেঙ্গে মাথার ওপর পরে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হেরিটেজ রক্ষার চেয়ে মানুষের জীবন এবং চিকিৎসা সেবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হেরিটেজকে রক্ষা করা যাবে কিন্তু আল্লাহ না করুন শত বছরের ভবন ধ্বসে যদি কেউ মারা গেলে তখন দোষ হবে সরকারের।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য যেটা কল্যাণকর সেটা আমি করতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন চানখারপুল এলাকায় শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ভবন নির্মাণ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অগ্নিকান্ড যেকোন সময় ঘটতে পারে। দুর্ঘটনা কবলিত মানুষ যাতে চিকিৎসা সেবা ভালভাবে পেতে পারে তার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন লোকবল বৃদ্ধি করা। উপযুক্ত জনবল তৈরীর জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তাই, এ প্রকল্পটি খুব দ্রুত প্রণয়ন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা জায়গা দিয়েছি, অর্থ দিয়েছি এবং সেনাবাহিনীর হাতে আমরা প্রকল্পটা দ্রুত সম্পন্ন করার দায়িত্ব দিয়েছি। এখানে সেনা প্রধান উপস্থিত আছেন, তিনি আমাকে কথা দিয়েছেন অতি দ্রুত তিনি আমাকে এটা সম্পন্ন করে দেবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এটি একটা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট হচ্ছে। ফ্লাইওভার বা ফুটওভার ব্রীজ করে এর সাথে বার্ণ ইউনিটের একটা সংযোগ করে দিতে হবে যাতে রোগীরা সহজে এখানে আসা যাওয়া করতে পারে।
তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলের বর্তমান বার্ণ ইউনিটে যারা আছেন তারা যেন উন্নত চিকিৎসা পান আবার ইনস্টিটিউটে যারা আছেন তারাও যেন সেখানে রোগীদের প্রয়োজনে সহজেই যাতায়াত করতে পারেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সেনাবাহিনী প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালিক এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণের মেয়দ সাঈদ খোকন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা করেন বার্ণ ইউনিট সমূহের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন।
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি একটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এর পরিচিতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, আমরা সমগ্র বাংলাদেশে প্রত্যেকটা মেডিকেল কলেজে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করবো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কমিউনিটি ক্লিনিক করে ৩০ রকমের ওষুধ বিনামূল্যে দিচ্ছি এবং জেলা হাসপাতালগুলোর শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে সেগুলোকে আধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত করার উদ্যোগ নিয়েছি। ’৯৬ সালে আমরা ক্ষমতায় থাকতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য রেফারেল সিস্টেম করে দিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা মেডিকেলে রোগী এসে ঘুরে বেড়াতো। কোথায় চিকিৎসা পাবে, কোন হদিস পেতনা। আমরা রেফারেল সিস্টেম করে ঢাকা মেডিকেলের দুটি ওয়ার্ডকে তার আওতায় এনে চিকিৎসা ব্যবস্থা সন্নিবেশিত করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী দেশে মেডিকেল শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তাঁর সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে বলেন, আমরা দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করেছি। চট্টগ্রাম এবং রাজশাহীতে আরো দুটো মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্থানীয় মেডিকেল কলেজগুলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবে এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পোষ্ট গ্রাজুয়েট স্টাডি এবং গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হবে। নার্সিং ইনস্টিটিউট এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে। তবে, বিশ্বদ্যিালয় ক্যাম্পাস শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যবহার হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিত্য নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে, চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে, এজন্য গবেষণার কোন বিকল্প নেই। এছাড়া ওয়েবক্যামের মাধ্যমে উপজেলা-জেলা হাসপাতালগুলোর সঙ্গে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষায়িত মেডিকেলের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা হবে যাতে চিকিৎসার জন্য সবাই যেন নিজস্ব অভিমত এবং চিকিৎসা পদ্ধতি শেয়ার করতে পারে।
তিনি বলেন, এই ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গেও যুক্ত করে দেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আমরা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে নতুন ধারায় গড়ে তুলবো।
উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ণ ইউনিট সম্পর্কে একটি তথ্য চিত্র পরিবেশিত হয়। এক দশমিক ৭ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন ১৭ তলা এই হাসপাতাল ভবনটিতে ৫শ শয্যা বিশিষ্ট বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সহ আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সব রকমের সুযোগ-সুবিধার সন্নিবেশ করা হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন অত্যাধুনিক এ ইনস্টিটিউটটি নির্মাণে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৫’শত ২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আগামী ২০১৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের চিকিৎসকরা মেধাবী। আমি মনে করি, দেশেই জনগণকে বিদেশের সমমানের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া উচিত।
তিনি উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা দেয়ার মাধ্যমে আমাদের চিকিৎসা সেবার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সচেষ্ট হতে চিকিৎসক সমাজের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী দেশে স্বাধীনতা উত্তর চিকিৎসাসেবার বিকাশে জাতির পিতার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে প্রথম সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট খোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতা উত্তর সময়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নততর চিকিৎসার জন্য লুধিয়ানা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থোপেডিক সার্জন ডাঃ আর জে গাষ্টকে বাংলাদেশে আনেন। ডাঃ গাষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজনে একজন প্লাস্টিক সার্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা জানালে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় প্লাস্টিক সার্জন ডাঃ পি বেজলীলকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা তাঁর সাড়ে তিন বছরের সরকারের সময়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালেই সংবিধান প্রণয়ণের পাশাপাশি দেশের চিকিৎসা খাতের উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ নেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করা হলে থেমে যায় চিকিৎসাখাতসহ দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকা-। পরবর্তী ২১ বছর চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই বিশেষায়িত শাখার বিস্তারে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী ’৯৬ পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনের সময়কার দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা স্মরণ করে বলেন, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তখন চারিদিকে বিএনপি-জামাতের রেখে যাওয়া অচলাবস্থা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দগ্ধ রোগীদের অসহনীয় দুর্ভোগ, সীমাহীন অব্যবস্থাপনা। দগ্ধ রোগীরা শুয়ে আছে মেঝেতে, বাথরুমের পাশে। এজন্য আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দ্বিতীয় ইউনিট করে দিয়েছি। অগ্নিকা-ের শিকার রোগীদের চিকিৎসাসেবার জন্য আমি তখনই উদ্যোগ নেই বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠার।
তিনি বলেন, ‘আমি ২০০০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট দেশের সর্বপ্রথম বার্ন ইউনিটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। ভবনসহ আনুষাঙ্গিক ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কাজ আমরা শেষ করে যাই। কিন্তু এরই মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জনবল ও সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি রেখে ইউনিটের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা হয়। প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয় অগ্নিকা-ে আহত অসহায় মানুষ।’
প্রধানমন্ত্রী নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘সে দুর্ঘটনার অগ্নিদগ্ধ রোগীদের এই বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হয়। সেই বেদনাদায়ক ঘটনার পর আমরা এই ইউনিটে একটি অত্যাধুনিক ১০ বেডের আইসিইউ, ৪০ বেডের অত্যাধুনিক হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) এবং শিশুদের হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) স্থাপন করি।’
প্রধানমন্ত্রী বিএনপি জামায়াতের আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার দুঃসহ দিনগুলির কথা স্মরণ করে বলেন, ‘বিএনপি-জামাত জোট ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে এবং ২০১৫ সালে টানা ৯২ দিন অবরোধের নামে সারাদেশে ঘৃণ্য ও পৈশাচিক সন্ত্রাস চালায়। অনেকে আগুনে দগ্ধ হয়েছেন, জীবনের তরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। যা কেবল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হায়েনা ও তাদের দোসরদের নির্মমতার সাথেই তুলনা করা যায়।’
তিনি সে সময় নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করায় বার্ণ ইউনিটের চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বার্ন ইউনিটে তখন ছিল দগ্ধ মানুষের চিৎকার, অসহায় রোগীদের উপচে পড়া ভীড়। বার্ণ ইউনিটের চিকিৎসক ও নার্সসহ যারা এই দুঃসময়ে সীমিত সুযোগ সুবিধা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে আগুনে পোড়া রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদেরকে তিনি ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমরা চিকিৎসক ও নার্সসহ চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক জনবল নিয়োগ করেছি। নার্সদের মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে।
দেশের প্রবৃদ্ধি বর্তমানে সাত শতাংশ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭১ বছর হয়েছে। মাথা পিছু আয় বেড়ে হয়েছে ১৪শ ৬৬ ডলার।
শেখ হাসিনা বলে, ‘আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ।’
এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি দেশের স্বাস্থ্যখাতে সম্পৃক্ত সকলকে এগিয়ে আসারও আহবান জানান।