জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজামী আল-বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। নিজামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের মধ্যদিয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থায় আরো একটি ইতিহাস রচিত হলো। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাসস’কে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সকল বিধি-বিধান মেনেই এ রায় কার্যকর করা হয়েছে। এ রায়ের মধ্যদিয়ে জাতির একটি কালো অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো।
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মানবতাবিরোধী এ অপরাধীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর মরদেহের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়।
পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া প্রহরায় লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাবনায় তার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তার মরদেহ দাফনের কথা রয়েছে।
এদিকে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে এবং সংশ্লিষ্ট জেলায় যাতে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে জন্য জেলার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে বিজিবি, র্যাব, ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনী টহল দিতে শুরু করেছে।
রায় কার্যকরের পূর্বে নিজামীর সঙ্গে তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেষ দেখা করেন ।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এটি হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার পঞ্চম ফাঁসি কার্যকর।
এ দন্ড কার্যকরের সময় অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ইকবাল, কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেসার আলমসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ঢাকার জেলা প্রশাসক মো. সালাউদ্দিন, ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবদুল মালেক মৃধা, কারা হাসপাতালের চিকিৎসক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে একাধিক লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্সও কারাগারে রাখা হয়।
কারা সূত্র জানায়, কারাগারে তাকে শেষ গোসল করানো হয়। নিজামীকে তওবা পড়ান কারাগার পুকুরপাড় সংলগ্ন মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মনির হোসেন খান। আগের ৪ যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকরের আগেও তাদের তওবা পড়িয়েছিলেন মাওলানা মনির।
দন্ড কার্যকরকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় কারাগার ও এর আশপাশের এলাকায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ সময় বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। কারাগারের প্রবেশ পথে সাধারণের চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণা আরোপ করা হয়।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধী দায়মুক্তির পথ ঊন্মোচন হয়।
গত ৫ মে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে আপিলের রায় রিভিউ’র আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ রিভিউ খারিজ করে জনাকীর্ণ আদালতে আদেশ দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
নিজামীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে আপিলের রায় রিভিউ’র আবেদন খারিজ করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় তাকে পড়ে শোনানো হয়। সোমবার রাত পৌনে নয়টার কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে নিজামীকে রায়টি পড়ে শোনানো হয়। গতরাতে চিকিৎসকরা তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তিনি সুস্থ ছিলেন বলে কারা সূত্র জানায়।
নিজামীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার কেশব রার চৌধুরীর নেতৃত্বে চার কর্মকর্তা লাল ফাইলে মোড়ানো রায়ের কপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দেন। সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী গতকাল বিকেল ৫টার কিছু পর এ রায়ের কপি বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে দেন। একইসঙ্গে রায়টি পাঠানো হয় আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকার জেলা প্রশাসকের (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) কাছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক বলেন, রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়া রায়ের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এতে স্বাক্ষর হওয়ার পর ওই আদেশ ও রায়ের কপি কারা কর্তৃপক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
নিজামীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আনা আপিলের রায় গত ৬ জানুয়ারি ঘোষণা করে আপিল বিভাগ। রায় প্রদানকারী বিচারপতিদের স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে ১৫ মার্চ পূর্র্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। রায় প্রকাশের পর নিয়ম অনুযায়ী ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন দায়ের করার সুযোগ ছিলো। সে অনুযায়ি রিভিউ দায়ের করে আসামিপক্ষ।
বাংলাদেশের তৃতীয় কোন সাবেক মন্ত্রী ’৭১-এ সংগঠিত মানবতাবতাবিরোধী অপরাধে সর্বোচ্চ দন্ড পেলেন। এর আগে সাবেক মন্ত্রী জামায়ায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করার পর একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।