এই প্রথম ভারতের নাগরিক হিসাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে চলেছে ছিটমহল৷ এতদিনে ছিটমহল তার নিজের রাষ্ট্রীয় পরিচয় পেলেও, এখনও রয়েছে সেখানে একাধিক সমস্যা৷ বিদ্যুৎ সরবরাহ-রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জমির মালিকানা ইত্যাদি সমস্যায় সেই স্বাধীনতার পর থেকেই ভুগছে ছিটমহল৷ নবপ্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই চিন্তা ঘুচছে না ছিটের বাসিন্দাদের৷ এবার ভোটাধিকার মেলায় ছিটমহলে খুশির হাওয়া৷ কিন্তু একইসঙ্গে তাদের দাবি, বিনিময়ে চাই উন্নয়ন৷ পরিত্রাণের প্রতিশ্রুতি যাঁরাই দেবেন, বিধানসভা ভোটে তাঁদেরই সমর্থন জানাবে ছিটমহল৷ দাবি সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের সংগঠন ‘নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় কমিটি’র৷ কমিটির সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্তের দাবি, ‘‘আমরা এলাকায় পোস্টার সাঁটিয়ে আমাদের দাবি জানাব৷ ছিটমহল বিনিময় হলেও, এখনও মানুষের কষ্ট কমেনি। কোনও রাজনৈতিক দলের নেতারা এই তল্লাটে একবারের জন্যও আসেননি৷ আমরা জানি, ভোট চাইতে আসবেনই ওঁরা। বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও জমির মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে, আমরা তাদেরকেই সমর্থন করব৷ ছিটমহলের দীর্ঘদিনের যন্ত্রণার আমরা পরিত্রাণ চাই৷’’
দীর্ঘ সমস্যায় যন্ত্রণা নিয়ে আজও দিন গুজরান ছিটমহলের৷ এমনই এক ছিটমহলের বাসিন্দা স্বপন দাস৷ এখানেই কেটেছে তাঁর ৩৮টি বছর৷ স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সংসার৷ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের মাঝে মাত্র এক বিঘা চাষের জমি৷ তাও আবার একটু বর্ষাতেই হাঁটুজল৷ বছরে তিনবার ধান ফলিয়ে কোনও রকমে উনুন জ্বলে হেঁসেলে৷ স্বপনবাবুর দাবি, ‘‘চাষ করে খাই৷ এত দিন কোনও পরিচয় ছিল না৷ এবার পেয়েছি৷ এবার প্রথম ভোট দেব৷ জানি না, ভোট দিয়ে কোনও ফল পাব কি না৷’’ ফারুক রহমান৷ বয়স ৬২৷ সরু মাথায় ধবধবে পাক-ধরা চুল৷ তিন ছেলে৷ নাতি-নাতনিদের সামাল দিতেই কাটে সময়৷অবসর কাটে তাস-দাবাতেই৷ আর সময় পেলে পরিবারের অন্য সদস্যদের বিড়ি বাঁধার কাজেও সহযোগিতা করেন৷ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘গোটা জীবনটাই তারকাঁটার ফাঁকেই কাটিয়ে দিলাম৷ মায়ের হাত ধরে এসেছিলাম৷ কিন্তু, কে জানত সাহেবদের জমি-ভাগাভাগির মাঝে পড়ে যাব৷ আজও মনে পড়ে সেই দিন৷ মায়ের কাছে শুনেছি কত গল্প৷’’
ছিটমহলের ইতিহাস বলতে যা শোনা যায় তা এক অদ্ভুত কাহিনি৷ তখন মুঘল আমল৷ সেই আমলেই কোচবিহার রাজ্যের দক্ষিণে রংপুরের কিছু এলাকা আকবরের সেনাপতি মানসিংহ দখল করে নিজেদের অধীনে নেন। এই রংপুরের রাজাদের সঙ্গে কোচবিহারের রাজাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। ছিল রেষারেষি৷কথিত যে, সেই সময় তিস্তা নদীর পাড়ে উভয় রাজাদের মধ্যে শতরঞ্জ কিংবা পাশার প্রতিযোগিতা হত। প্রতিযোগিতার পুরস্কার বা বাজি হিসাবে রাখা হত এক টুকরো কাগজ৷ যাতে লেখা থাকত নিজ নিজ রাজ্যের কোনও একটি এলাকার নাম। বিজয়ী রাজা সেই এলাকার দখল নিতেন। কখনও কখনও ঋণ পরিশোধের কারণেও কিছু কিছু এলাকা দিয়ে দেওয়া হত। এভাবেই একটি রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন বা ছিটকে যাওয়া এলাকাগুলি অন্য রাজ্যের অধীনে চলে যায়। পরবর্তীতে যেগুলি ছিট বা ছিটমহল বলে পরিচিতি পায়। এতে সেভাবে ছিটমহলের বাসিন্দাদের খুব বেশি অসুবিধার কারণ ছিল না। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয় ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানকালে দেশ বিভাজন এবং তার পরবর্তী ঘটনাচক্রে। রংপুর পড়ে পূর্ব পাকিস্তানে ও পাঁচের দশকের গোড়ায় কোচবিহার ঢোকে ভারতে। সমস্যার শুরু তখন থেকেই।
সেই সময় কোচবিহার ও রংপুরের রাজাদের স্বার্থ, স্থানীয় জমিদারদের ক্ষমতার লোভ, চাবাগান মালিক ও ভূস্বামীদের প্রতি তোষণ নীতির জেরে সীমানা নির্ধারণের কাজটি থমকে যায়৷চলে যাওয়ার আগে চোরকে চুরি করতে এবং গৃহস্থকে সাবধান হতে বলার ব্রিটিশ বিভাজন কৌশল তাতে ঘৃতাহুতির কাজ করে৷ স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় ভিন দেশের এক্তিয়ারে৷ ছিটমহল এলাকার মানুষ হয়ে যান নিজভূমে পরবাসী। সমস্যার শুরু সেখানেই।
সেই সমস্যায় আজও ভুগছেন বাংলাদেশে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ১৪ হাজার ২১১ জন বাসিন্দা৷ নিজভূমে পরবাসী এই মানুষদের সমস্যা সমাধানের জন্য দীর্ঘ ৪১ বছর পর গত ৬ জুলাই, ২০১৫-এ ঢাকায় মোদী-হাসিনার উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয় স্থলসীমান্ত চুক্তি। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী-মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তি নতুন করে প্রাণ পাওয়ায় দেশ ফিরে পান মোট ৫১ হাজার ৫৮০ জন ছিটমহলবাসী৷ ভারতের নাগরিকত্ব পান ১৪ হাজার ২১১ মানুষ৷ আর তারই জেরেই এবার ছিটের বাসিন্দারা বিধানসভা ভোটে এই প্রথম অংশ নেবেন৷ এর মধ্যে দিনহাটা, সিতাই, শীতলকুচি, মাথাভাঙা বিধানসভা কেন্দ্রে প্রায় ১০ শতাংশ ছিটমহলের ভোট রয়েছে৷ ফলে ওই কেন্দ্রগুলির ভাগ্য নির্ধারক না হলেও বেশ প্রভাব ফেলতে পারে ছিটের ভোট৷ দিনহাটা, সিতাই, শীতলখুচি, মাথাভাঙা– এই চারটি কেন্দ্রেই তৃণমূল প্রার্থী ঘোষণা করেছে৷ বামেরাও ওই চারটি কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছে৷বিজেপি এখনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি৷ সব মিলিয়ে এই নির্বাচনে ছিটমহলের ভোট একটা নিজস্ব জায়গা করে নিতে চলেছে ওই চার বিধানসভা কেন্দ্রে৷