রাষ্ট্্রপতি আবদুল হামিদ দেশের মাটি থেকে যেকোন মূল্যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের আহবান জানিয়ে বলেছেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। কিছু ধর্মান্ধ, বিপথগামী ও সন্ত্রাসী এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বর্তমানে বিশ্বশান্তির জন্য মারাত্মক হুমকি। সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা দেশের জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ব্যাপারে সরকারের স্পষ্ট ও সুদৃঢ় অবস্থান হচ্ছে জিরো টলারেন্স। আপনাদের এ নীতির আলোকেই সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন সফরে যাবেন তখন সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কুফল এবং এর পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে আপনারা অবহিত করবেন। যুবসমাজ ও কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে এসব অপকর্ম থেকে দূরে থাকে সে ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করবেন। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করবেন।
রাষ্ট্রপতি আজ ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের সাথে মতবিনিয় সভায় ভাষণকালে এ আহবান জানান।
রাষ্ট্রপতি জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের কাজের গতিকে ত্বরান্বিত করে অন্যদিকে কিভাবে আরো দক্ষতার সাথে জনগণের সেবা প্রদান করা যায় তার দিকনির্দেশনা এ সম্মেলনে প্রদান করা হয়েছে। দেশের আর্র্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষত জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
‘সরকারের মূল ভিত্তি এর জনগণ। সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের আশা-আকাঙ্খা ও স্বপ্নœ বাস্তবায়নে কাজ করা। আপনাদের মাধ্যমেই সরকার জনগণের কাছে সেবা পৌঁছে দেয়’Ñ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হিসেবে আপনাদের ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে এবং সেবার মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপোষের কোনো সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে আপনারা যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন জনগণ আপনাদের প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন করে থাকেন। এ ব্যাপারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’।
তিনি বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির পুনর্গঠনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। জাতীয় ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ভূমিকা পালনের দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের জনগণের সেবায় উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে।’
অনাবশ্যক আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জনগণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত এবং সকল প্রকার ভয়-ভীতি, অনুরাগ বা বিরাগ, তোষণ ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করতে ডিসিদের আহবান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এখনও জনগণের মাঝে নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। সেবা প্রদানে অহেতুক বিলম্ব পরিহার করতে হবে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দক্ষ, জ্ঞাননির্ভর ও আলোকিত জনপ্রশাসন খুবই জরুরি। প্রশাসনের প্রতিটি কাজে নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করে বলেন, জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব পালনকালে সরকারি আইন, বিধি-বিধান ও জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিবেন। তাদের সুযোগ্য নেতৃত্ব মাঠপর্যায়ের অন্যান্য কর্মকর্তাদের অনুপ্রাণিত করবে এবং সরকারি কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে। নিজেরা আইন মেনে কাজ করবেন এবং অন্যরাও যাতে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবেন। মনে রাখতে হবে ‘মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়’।
দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নয়নে সদা তৎপর ও সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, ছোট আয়তনের এ দেশে ১৬ কোটিরও বেশি লোকের বসবাস। প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের ভূমি খুবই কম। ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও অপরিকল্পিত নগরায়নের সুযোগে একশ্রেণীর অসাধু লোক কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহযোগিতায় সরকারি জমি অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। তিনি ভূমি উদ্ধারে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানান।
তিনি বলেন, বিদেশ যেতে কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রবাসীদের আয় ও দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ফলে গ্রামে-গঞ্জে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন ব্যাপক হারে বাড়ছে। ফলে কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে তিনি এসব ব্যাপারে জেলা প্রশাসকদের সজাগ থাকার আহবান জাানান।
কৃষকরা যাতে সময়মতো সার ও কৃষি উপকরণ পায় এবং জমিতে পরিমিত কীটনাশক ব্যবহার করে সে ব্যাপারে তত্ত্বাবধান জোরদার করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মৎস্য ও পশু সম্পদের উন্নয়নেও অব্যাহত প্রয়াস চালাতে হবে।
রাস্তাঘাট নির্মাণে গুণগত মান নিশ্চিত করায় ডিসিদের উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, মোবাইল কোর্টের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর তৎপরতার ফলে খাদ্যে ভেজাল রোধ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ ও ইভ-টিজিং রোধসহ সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। এ সকল কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
রাষ্টপতি বলেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদেরও নতুন নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে মনোযোগী হতে হবে। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে নবীন কর্মকর্তা ও স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েরা যাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উৎসাহী হয় সে ব্যাপারে আপনাদেরকে উদ্যোগী হতে হবে।
তিনি বলেন, একবিংশ শতাব্দীর এই তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এগ্রিয়ে যাওয়ার জন্য দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। এ জন্য প্রয়োজন একটি সৎ, দক্ষ, চৌকস ও দেশপ্রেমিক প্রশাসনযন্ত্র। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারীকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আপনাদের দায়বদ্ধতা থাকবে রাষ্ট্র, জনগণ, আইন ও সংবিধানের প্রতি। সরকারের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় অব্যাহত প্রয়াস চালাতে হবে।
মন্ত্রী ও নীতি নির্ধারকদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা অনুসারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে বিভাগীয় কমিশার ও ডিসিদের আহবান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, মাঠপর্যায়ের বাস্তব অবস্থা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে অবহিত করবেন এবং প্রস্তাবনা পেশ করবেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও এসব প্রস্তাবনা যথাযথ মূল্যায়ন করে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
রাষ্ট্রপতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশাত্মবোধ ও একাগ্রতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করার আহবান জানিয়ে দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করে বলেন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রশাসনের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ঐকান্তিক প্রয়াস আগামীতে আরো বেগবান হবে।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম স্বাগত ভাষণ দেন এবং ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার জি এম সালেহউদ্দিন বক্তৃতা করেন। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামাল ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠাে রাষ্ট্রপতির সচিবগণ উপস্থিত ছিলেন।BSS