25 C
Bangladesh
Thursday, March 30, 2023
Homeকোরআনশব-ই বরাতের আমল ও ফজিলত

শব-ই বরাতের আমল ও ফজিলত

kobid_203495905651c6e805663e51.91477643_xlargeমধ্য-শাবান হচ্ছে আরবী শা’বান মাসের ১৫ তারিখ, যা  উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যেশবে বরাত বা শব-ই-বরাত নামে পালিত একটি পূণ্যময় রাত। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানগণ বিভিন্ন কারণে এটি পালন করেন।এই রাতকে লাইলাতুল বরাত বলা হয়।

হযরত সায়্যিদুনা আলীয়্যুন মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্নিত, নবী করিম রঊফুর রহিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান বানী, যখন শাবানের ১৫তম রাতের আগমন ঘটে তখন তাতে কিয়াম (ইবাদত) করো আর দিনে রোযা রাখো । নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা সূর্যাস্তের পর থেকে প্রথম আসমানে বিশেষ তাজাল্লী বর্ষন করেন, এবং ইরশাদ করেনঃ কেউ আছ কি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কারী? তাকে আমি ক্ষমা করে দিব ! কেউ আছ কি জীবিকা প্রার্থনাকারী? তাকে আমি জীবিকা দান করব ! কেউ কি আছ মুসিবতগ্রস্ত? তাকে আমি মুক্ত প্রদান করব! কেউ এমন আছ কি! কেউ এমন আছ কি! এভাবে সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ পাক তার বান্দাদেরকে ডাকতে থাকবেন ।

ইতিহাস:

এই বিশেষ রাতের ব্যাপারে কুরআনে তেমন কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে, সিয়াহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়খানা হাদিস গ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই রাতের কথা ইমাম তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে পাওয়া যায়, ঐ হাদিস মতে, এক রাতে ইসলামের নবী মুহাম্মদের(সাঃ) স্ত্রী আয়েশা ঘুম থেকে উঠে পড়লেন কিন্তু মুহাম্মদ(সাঃ)কে বিছানায় দেখতে পেলেন না। তিনি মুহাম্মদকে(সাঃ) খুঁজতে বের হলেন এবং তাঁকেজান্নাতুল বাকি কবরস্থানে দেখতে পেলেন। মুহাম্মদ(সাঃ) বললেন, ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ সর্বনিম্ন আকাশে নেমে আসেন এবং [আরবের] কালব্‌ উপজাতির ছাগলের গায়ের পশমের থেকে বেশি লোককে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করেন। উল্লেখ্য, সেসময় কালব্ গোত্র ছাগল পালনে প্রসিদ্ধ ছিল এবং তাদের প্রচুর ছাগল ছিল। এই হাদিসের নিচে ইমাম তিরমিযী উল্লেখ করেন, “হযরত আবু বকরও [রা.] এরূপ হাদিস বর্ণনা করেছেন বলে জানা যায়।

হযরত আয়েশা সিদ্দীক ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা ) বর্ণনা করেন, মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে আয়েশা! তুমি কি জান? আজ রাত ( নিসাফে শাবান ) কী? হযরত আয়েশা ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা ) বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো জানি না, দয়া করে বলুন। মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বললেন, আজ রাতে আগামী বছরে যে সমস্ত বনী আদম জমীনের বুকে জন্মগ্রহণ করবে এবং আরা মৃত্যুবরণ করবে, তাদের তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে বান্দাদের আমলনামা মহান আল্লাহর নিকট প্রকাশ করা হয়।

হযরত আয়েশা ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা ) থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদীসে মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বলেন, আমি এক রাতে মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ঔয়া সাল্লাম )-কে বিছানায় পেলাম না। তাই আমি অত্যন্ত পেরেশান হয়ে খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করলাম। খুঁজতে খুঁজতে দেখি, তিনি জান্নাতুল বাকীর মধ্যে মহান আল্লাহর প্রার্থনায় মগ্ন। তখন তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! আমার নিকট হযরত জিবরাইল ( আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আজ রাত হল নিসফে শাবান ( অর্থাৎ, লাইলাতুল বারাআত )। এ রাতে আল্লাহ তাআলা অধিক পরিমাণে জাহান্নামবাসী লোকদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এমনকি কালব বংশের বকরীগুলোর লোম সমপরিমাণ গুনাহগার বান্দা হলেও।  ( মিশকাত শরীফ-১১৫ পৃ )

হযরত মুআয ইবনে জাবাল ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ) বলেন, রাসূলে করীম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে ( শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে ) সৃষ্টির দিকে ( রহমতের ) দৃষ্টি দেন এবংগ মুশরীক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহর তাআলার পক্ষ থেকে মাগফিরাতের দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত করা হয়। কিন্তু শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যাপক রহমত, মাগফিরাত ও সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত থাকে।

যদি শবে বরাতের ব্যাপারে অন্য কোন হাদীস নাও থাকত, তবুও এ হাদীসটিই এ রাতের ফজীলত ও মর্যাদা প্রমাণ করার জন্য এবং এ রাতে মাগফিরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত। তদুপরি দশজন সাহাবী থেকে শবে বরাতের ফজীলত, মর্যাদ ও আমল সম্পর্কে হাদীস বর্ণিত রয়েছে। অবশ্য এর কোন কোনটির সনদ দূর্বল। আর এই সনদগত দূর্বলতার কারণে কেউ কেউ বলে দিয়েছেন, এ রাতের ফজীলত ভিত্তিহীন। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ ও ফকীহগণের ফয়সালা হল, কোন একটি হাদীস যদি সনদগতভাবে দূর্বল হয়, তারপর বিভিন্ন হাদীস দ্বারা তা সমর্থিত হয়, তাহলে এ সমর্থনের কারণে তার দূর্বলতা দূর হয়ে যায়।

শবে বরাতের আমল:

রাতে ইবাদত করা: হযরত আলা ইবনে হারিস ( রহমতুল্লাহি আলাইহি ) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়িশা ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা ) বলেন, একবার রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হয় তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তখন তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা বা ও হুমাইরা! তোমার কি এ আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি বললাম, তা নয়, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা দেখে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যু বরণ করেছেন কিনা। নবীজী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) ভাল জানেন। রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বললেন, এটা হল অর্ধ শাবানের রাত। আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানে তাঁর বান্দাদের প্রতি নজর দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।

                                                                          ( বায়হাকী, ৩য় খন্ড-৩৮২পৃ )

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া উত্তম, যাতে সিজদাও দীর্ঘ হবে। এছাড়াও এ রাতে কুরআন তেলাওয়াত, যিকির আযকার ইত্যাদি আমল করা যায়।

পরদিন রোযা রাখা

হযরত আলী ( রাদীয়াল্লাহু তাআলা আনহু ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বলেছেন,পনেরো শাবানের (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে, তখন তোমরা রাতটি ইবাদত বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনে রোযা রাখ। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা পড়থম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছে কি কোন রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দিব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদেরকে ডাকতে থাকেন।

   ( সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-১৩৮৪, বাইহাকী-শুআবুল ঈমান, হাদীস-৩৮২৩ )

এই রিওয়াতটির সনদ যইফ। কিন্তু মুহাদ্দিসীনে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যইফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া শাবান মাসে বেশী বেশী নফল রোযা রাখার কথা বহু হাদীসে এসেছে এবং আইয়ামে বীজ তথা প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ( ইসলাহী খুতুবাত, ৪র্থ খন্ড-২৬৬পৃ )

ইবাদত করতে হবে নির্জনে

এ বিষটি মনে রাখতে হবে, এ রাতের আমলসমূহ বিশুদ্ধ মতানুসারে সম্মিলিত নয়; নির্জনে একাকীভাবে করণীয়। পুরুষদের জন্য তো ফরয নামাজ অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। তারপর তারা এবং মহিলারা যা কিছু নফল পয়রার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বেন। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদীসে নেই। আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (ইকতিযাউস সিরাতুল মুস্তাকিম,২য় খন্ড-৬৩১পৃ, মারাকিল ফালাহ-২১৯পৃ )

তবে কোন ঘোষণা ও আহবান ছাড়া এমনিতেই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যান, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবেন। একে অন্যের আমলে ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হওয়া যাবে না।

শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসিমানী ( দামাম বারকাতুম ) বলেন, ইমাম আযম আবু হানীফা ( রহমতুল্লাহি আলাইহি ) বলেছেন, নফল ইবাদত এমনভাবে করবে যে, সেখানে কেবল তুমি আছ, আর আছেন আল্লাহ। তৃতীয় কেউ নেই। সুতরাং, যে কোন নফল ইবাদতের ক্ষেত্রেই শরীয়তের অন্যতম মূলনীতি হল, তাতে জামাআত করা মাকরুহে তাহরীমী ও নিষিদ্ধ। ( ইসলাহী খুতুবাত, ৪র্থ খণ্ড-২৬৮পৃ )

হযরত আশরাফ আলী থানভী ( রহমতুল্লাহি আলাইহি )-এর মতঃ

তিনি বলেন হাদীসে শবে বরাতের তিনটি কাজ সুন্নত মত করাকে সওয়াব ও বরকত লাভের উপায় বলা হয়েছে। প্রথমতঃ পনেরো তারিখ রাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা। সাথে সাথে গরীব মিসকীনদের কিছু দান করে সে দানের সওয়াবটুকু ঐ মৃতদের নামে বখশে দিলে আরও ভাল হয়। সেই মুহূর্তে হাতে না থাকলে, অন্য সময় গোপনে কিছু দান করে দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়তঃ রাত জেগে একা একা বা বিনা আমন্ত্রণে জড়ো হয়ে যাওয়া দু চারজনের সাথে ইবাদতে মশগুল থাকা। তৃতীয়তঃ শাবানের পনেরো তারিখ নফল রোযা রাখা।

সঠীক নিয়মে এ রাতে আমল করেই কেবল উপরোক্ত ফজীলতের অধিকারী হওয়া যাবে। আর বিশেষ ক্রে সারা জীবনের গুনাহ থেকে তওবা করে এ রাতে আত্মশুদ্ধির প্রত্যয় গ্রহণ করা এবং সেই অনুযায়ী সারাজিবন চলা আমাদের কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরর সকলকে আমল করার তৌফিক দান করুন।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

Most Popular

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

Recent Comments