পাঁচদিনের ব্যবধানে দেশের তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্রে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন ব্যবসায়ীরা। ধারাবাহিক ও ভয়াবহ এসব অগ্নিকাণ্ড এখন আর কোনোভাবেই নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। এগুলো দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব ঘটনা সুপরিকল্পিত ও গভীর দেশবিরোধী নাশকতার অংশ কি না- সে বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত করার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে (কেপিআই) নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে আরো তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গতকাল রোববার সরকারের উচ্চপর্যায়ে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়। বৈঠকে নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। এতে বিমানবন্দর, মিরপুর ও চট্টগ্রামের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের বিষয় গুরুত্ব পায়। বৈঠকে শাহজালাল বিমানবন্দরের ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে বলা হয়।
উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গতকাল তিনটি নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সংস্থা, পুলিশ সদর দপ্তর, সংশ্লিষ্ট বিভাগ, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধারাবাহিক বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে বিমানবন্দরে আগুনের ঘটনায় সব ধরনের তথ্যাদি তদন্তের স্বার্থে পর্যালোচনা করতে বলা হয়। এ ঘটনায় দেশি-বিদেশি কোনো চক্রান্ত রয়েছে কি না, তাও খুঁজে দেখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া মেট্রোরেল, গুরুত্বপূর্ণ সিভিল ও সামরিক-সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ঝুঁকি দ্রুত নিরূপণের জন্য বলা হয়। সভায় নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট তিনটি সংস্থাকে প্রো-অ্যাকটিভ (সক্রিয়) হয়ে তৎপরতা জোরদারের জন্য বলা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর বিষয়েও।
সংস্থাগুলোর একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র ও বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১৪ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে কেমিক্যাল গোডাউন ও পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) একটি বৃহৎ কারখানায় বিধ্বংসী আগুন এবং সর্বশেষ গত শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে লক্ষ্য করে চালানো এক গুরুতর ষড়যন্ত্র বলেই মনে হয়। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রাথমিকভাবে মনে করছে, এই চক্রের মূল উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, দেশের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত হানা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করা। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ও নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মৌখিক নির্দেশনায় সারা দেশে সতর্কাবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেছেন, বিমানবন্দর হলো কেপিআই এলাকা। আগুন লাগার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ সংস্থা ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও এই ধূম্রজালের ভেতর দিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছার মতো অবস্থা ছিল না।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড তদন্তে নাশকতাসহ কোনো কিছু উড়িয়ে দেব না। গোয়েন্দা সংস্থাসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে এর রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করব।
উপদেষ্টার এই বক্তব্য সরকারের পক্ষ থেকে নাশকতার সম্ভাবনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। এ ঘটনায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) পৃথক দুটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এদিকে বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর সিভিল অ্যাভিয়েশনের (বেবিচক) উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের অহেতুক দেরির কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উত্তরাসহ একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছালেও সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অগ্নিনির্বাপণের কাজ শুরু করার আনুষ্ঠানিক অনুমতি পেতে বিলম্ব হয়। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক পরে সাংবাদিকদের জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বড় বাধা ছিল বাতাস।
ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা বলছেন, বেবিচকের কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। এই বিলম্বের ফলেই আগুন কার্গো ভিলেজের আমদানি পণ্য, গার্মেন্টস, কেমিক্যাল ও মেশিনারিজের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে; ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে।
কার্গো ভিলেজ থেকে ধোঁয়া ও আগুনের কুণ্ডলী বাড়ার পরও কাজ শুরু করতে দেরির বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে এবং এই প্রশাসনিক গাফিলতি খতিয়ে দেখার জন্য জোর দাবি উঠেছে। এই প্রশাসনিক দুর্বলতাও নাশকতার পরিকল্পনাকারীদের সুবিধা করে দিয়েছে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
নিরাপত্তা সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিমানবন্দরে সফল নাশকতার পর ষড়যন্ত্রকারী চক্রটি পরবর্তী টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছে দেশের আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার অন্যতম প্রতীক মেট্রোরেলকে (এমআরটি)। মেট্রোরেলে নাশকতা ঘটিয়ে জনগণের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং সরকারের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। মেট্রোরেলের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি ও সামরিক-সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলো (কেপিআই) পরবর্তী নাশকতা প্রচেষ্টার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতিতে বলেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করতে দেশি ও আন্তর্জাতিক শত্রুরা এখনো তৎপর। সম্প্রতি দেশে কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে আগুন লাগার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত বলে জনগণ বিশ্বাস করে।’ জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে না দেখে ‘চক্রান্তের একটি অংশ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে, বিকেএমইএ সভাপতিও শাহজালাল বিমানবন্দরের আগুনে ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান তার ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কি আকস্মিক দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা? নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, একই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় এবং অগ্নিকাণ্ডের ধরন দেখে বোঝা যায় এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
নাশকতার পরিকল্পনার সঙ্গে একটি রাজনৈতিক যোগসূত্রের তথ্যও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তদন্তের আওতায় এসেছে। নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র দাবি করেছে, আওয়ামী লীগের পতনের পর পালিয়ে যাওয়া দলটির বহু নেতা গত আগস্টে ব্যাপক নাশকতার মাধ্যমে দেশে ফেরার পরিকল্পনা করেছিলেন, যা ব্যর্থ হওয়ায় তারা অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসকে টার্গেট করে নাশকতায় নেমেছেন। এই নাশকতার বিষয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বাহাউদ্দিন নাছিম, মাহবুব-উল আলম হানিফ, নওফেল, জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ কয়েকজন নেতা সমন্বয় করছেন বলে জানা গেছে। তারা কলকাতায় মিলিত হয়ে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন দিল্লিতে পলাতক শেখ হাসিনার সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার সুযোগ পাচ্ছেন। গত ১১ অক্টোবর ভারতের দিল্লিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও নওফেল শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন, যার পরপরই দেশে ভয়াবহ তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এসব রাজনৈতিক যোগসূত্রকেও গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে।
এই ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবে সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীরাও তীব্র সন্দেহ ও ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। তারা বলছেন, এগুলো কোনো দুর্ঘটনা নয়, স্পষ্ট নাশকতা। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আগুন লাগছে- এটা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা।
নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কেপিআই) নিরাপত্তা আরো জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন সারা দেশে তাদের টহল, নজরদারি ও কেপিআইয়ের নিরাপত্তা প্রটোকল কঠোর করেছে।
নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নাশকতার এই ধারাবাহিকতা মোকাবিলায় কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই নয়, বরং সাধারণ জনগণের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান জরুরি।
দেশের অর্থনীতিকে লক্ষ্য করে এ ধরনের হামলা মোকাবিলায় শিল্পমালিক এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ ও জোরদারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
সূত্র: আমার দেশ